দুর্নীতির সংজ্ঞা কী হতে পারে? খুব সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় ক্ষমতার অপব্যবহার, কারণ ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথে কিছু অতিরিক্ত সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয় জড়িত থাকে। বলা বাহুল্য, এই অতিরিক্ত সুবিধা আসলে অনৈতিক সুবিধাকে নির্দেশ করে। আর এই অনৈতিক সুবিধা নেয়ার ক্ষেত্রে মূল আকর্ষণ থাকে অর্থ প্রাপ্তির। এখন বাংলাদেশের মোট ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে কতজনের পক্ষে এই রকম দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আহরণ করা সম্ভব? সম্ভব তাদের পক্ষেই যারা ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে বা এর আশেপাশে অবস্থান করেন। ঠিক কতজন এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত তা নিরুপণ করা সম্ভব নয়। তবে মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশ যে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুর্নীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ মানুষ। বিত্তশালীদের তাতে কিছু আসে যায় না, দুর্নীতির মাধ্যমে তারা সম্পদের পাহাড় গড়েন আর এর মূল্য দিতে হয় সাধারণ জনগণকে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী গত ২৪ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন। আর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারক, বিচার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১১ সংসদে উপস্থাপন হয়েছে।
এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুই একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য এটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের পর থেকেই সর্বত্র আলোচনার ঝড় বইছে। মূলত চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে এই আলোচনার ঝড়–সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অনুমতির বিধান; সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান তাদের গোপন তথ্য দুদককে না দিতে চাইলে কোনো রকম চাপ প্রয়োগ না করা; দুদকের দায়বদ্ধতা এবং মিথ্যা অভিযোগে মামলা হলে ৫ বছরের শাস্তির বিধান।
সংশোধনী প্রস্তাবের একটি ধারাই দুদককে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগগুলো আসলে কী? একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এগুলো হল সরকারি তহবিল তসরুপ, ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক আয়কর ফাঁকি অথবা জনসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা কর্তৃক সেবার বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ বা ব্যসায়িক অসাধুতা বা প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন। কারো একার পক্ষে এই ধরনের দুর্নীতি করে পার পাওয়া সম্ভব নয় যদি না সুবিধা গ্রহণকারী ও দুর্নীতিবাজের মধ্যে আগে থেকে এক ধরনের সমঝোতা থেকে থাকে। এখন এই ক্ষেত্রগুলোতে কি সাধারণ জনগন পড়েন? যদি নাই পড়েন তাহলে দুদক কার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করবে? সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়টিকে যদি আমলে নেয়া হয় তাহলে বলা যায় দুদক আইনের এই ধারাটি প্রকারান্তরে সরকারি কর্মকর্তাদের দুদকের আওতার বাইরে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। মামুলি এবং বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্নীতির মামলা করা ছাড়া দুদকের কার্যক্রম যে আরো স্থবির হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রস্তাবিত সংশোধনী বাংলাদেশ সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত সকল নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়টির সাথে সাংঘর্ষিক যা প্রকারান্তরে দায়মুক্তির নামান্তর হবে। সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদ শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিকে এ ধরনের দায়মুক্তি দিয়েছে। সুতরাং এই ধরনের সংশোধনী সাংবিধানিক হোঁচট খেতে পারে। যদি কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে যান তাহলে এই সংশোধনী নাও টিকতে পারে, এমন কি আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
রাষ্ট্রে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না যার কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না। দুদককেও অবশ্যই দায়বদ্ধতার আওতায় থাকতে হবে, প্রশ্ন হল কার কাছে। দুদকের দায়বদ্ধতার বিষয়ে অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। এ বিষয়টি বেশি সামনে এসেছে, যেমন দুদক যদি কোনো মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এক্ষেত্রে বলা, দুদকের দায়বদ্ধতা থাকবে জুডিশিয়ারির কাছে। একই সাথে দুদকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারে পাবলিক একাউন্টস কমিটির মাধ্যমে। একই সাথে মিথ্যা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ৫ বছরের শাস্তির বিধানটিও পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এ ধরনের বিধান দুদক কর্মকর্তাদের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করবে। প্রচলিত আইনি কাঠামোতেই মিথ্যা মামলা দায়েরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। এ রকম অবস্থায় আদালত দুদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ তথ্য প্রদানে বাধ্য না হলে তা এই সরকারের প্রণীত তথ্য অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। দুদকের মত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে যদি তথ্য পেতে কোনো বেগ পেতে হয় তাহলে সাধারণ মানুষের তথ্যপ্রাপ্তি কতটা নিশ্চিত হবে?
দুদক পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটিই ছিল ত্রুটিপূর্ণ, বিলুপ্ত ব্যুরোর লোকবল দিয়েই মূলত দুদকের যাত্রা শুরু হয়। আর এ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া যে ত্রুটিপূর্ণ ছিল তা সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেশি প্রমাণিত হয়েছে–মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের দায়ে এক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন, আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। নাম পরিবর্তন ছাড়া দুদক একটি স্বাধীন ও ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কখনোই আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়নি। জোট সরকারের আমলে ব্যুরো থেকে কমিশন মূলত দাতাগোষ্ঠির চাপের ফলাফল ছাড়া আর কিছু নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো আইনের কোনো রকম তোয়াক্কাই করেনি, দুদকের উপর ভর করেছিল টাস্ক ফোর্স আর জরুরি আইনের ভূত–যার কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না। মানবিক দিকটি উপেক্ষিত হয়েছিল পুরোপুরি। এই টাস্ক ফোর্স আর জরুরি আইনের কারণে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে একথা হলফ করে বলা যাবে না যে তারা সকলেই নির্দোষ ছিলেন। অনেক মামলাই বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যমে নিষ্পত্তি না হয়ে প্রত্যাহারের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন তারা চাইতেই পারেন এ ধরনের হয়রানির পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। কিন্ত বৃহত্তর স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অনুমতির বিধানটি অবশ্যই পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। বর্তমান মহাজোট সরকারের রূপকল্প ২০২১-এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। আর এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর ও দুদককে একটী স্বাধীন ও শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার অঙ্গিকারবদ্ধ। দুদক সংশোধনী এখনও প্রকাশিত হয়নি, এত আলোচনা সবই পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে–সাধারণ জনগণের এর বাইরে জানার আর কোনো সুযোগও নেই। তবে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আইনটি প্রণয়ন হওয়া পর্যন্ত। শুধু আইন প্রণয়নই নয়, দুদক আইনকে অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। দুদক চেয়ারম্যান ইতিপূর্বে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, দুদক এখন দন্তহীন বাঘ, এর অবশিষ্ট থাবাগুলোও কেটে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশাবাদী যে সরকার এমন কোনো আইন প্রণয়ন করবে না যা দুদকের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দুদককে একটি পরনির্ভরশীল ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
এই লেখাটি ১ মার্চ ২০১১ তে opinion.bdnews24.com/bangla তে প্রকাশিত
Leave a Reply